ক্রাইম রিপোর্ট ডেস্ক []মাতৃত্ব নারীর জীবনের অন্যতম আনন্দময় ঘটনা। যদিও একজন কর্মজীবী নারীর জন্য মা হওয়ার যাবতীয় সুখ তার পেশাগত জীবনের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী অনুষঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। গর্ভাবস্থায় বাড়তি কাজের বোঝা থেকে পরিত্রাণস্বরূপ নারীদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা প্রদান করা হয়। বিশ্বজুড়ে এ ধরনের সুবিধাগুলো সাধারণত প্রদান করা হয় নিয়মিত বেতনসহ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুসারে, একজন কর্মজীবী নারী মাতৃত্বকালীন ছুটি বাবদ বেতনসহ সর্বোচ্চ ২৪ সপ্তাহ ছুটি নিতে পারেন। তাকে চাকরিতে বহাল রাখার জন্যও বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যাতে মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে তিনি কাজে ফিরতে পারেন।
একদিকে প্রতিষ্ঠানভেদে আইনটির বাস্তবায়নে নানা নিয়ম ভাঙার চিত্র দৃশ্যমান, আবার আইনে উল্লিখিত সব সুবিধা সব শ্রেণীর পেশাজীবী নারীর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’—এ ধরনের মাতৃত্বকালীন ছুটির যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, তা নির্দিষ্ট কিছু পেশাজীবী নারীর জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়, বিশেষ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত নারীদের ক্ষেত্রে।
মাতৃত্বকালীন ছুটির প্যাকেজটি নারীদের পেশাগত ক্ষতির প্রকৃতি অনুসারে প্রদান করা উচিত। কারণ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বিশেষ করে গর্ভধারণের শেষ তিন মাস এবং সন্তান ভূমিষ্ঠের প্রথম ছয় মাস, যখন সন্তানকে স্তন্যদান করতে হয়—এ সময়ের পেশাগত ক্ষতি একেক পেশার জন্য একেক রকম। যে নারীরা কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে কর্মরত কিংবা যারা ব্যাংকার, প্রযুক্তিবিদ ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, তারা তাদের প্রতিদিনের দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকেন এবং তাদের কর্মদক্ষতা, কর্মঘণ্টা, কাজের তথ্যের ওপর পদোন্নতি নির্ভর করে। সুতরাং কাজে ফেরার নিশ্চয়তা ও ছয় মাসের বেতনসহ প্রচলিত মাতৃত্বকালীন সুবিধাগুলো এ ধরনের পেশাজীবী নারীদের জন্য খানিকটা কার্যকরী। তবে যারা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, একাডেমিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের পদোন্নতির শ্রেণীবিন্যাস কর্মঘণ্টা ও দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মোট প্রকাশনার সংখ্যা, রিসার্চ কার্যক্রম ও নিবন্ধ প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। গর্ভকালীন সময় এবং মাতৃত্বের শুরুতে একাডেমিক কাজের সঙ্গে জড়িত একজন পেশাজীবী নারীকে তার পদোন্নতির জন্য অফিসে উপস্থিতি ছাড়াও যে ধরনের অতিরিক্ত দক্ষতা দেখাতে হয়, তিনি তা পূরণে সক্ষম থাকেন না। প্রাকৃতিক এ ‘প্রডাক্টিভিটি গ্যাপ’ বা উৎপাদনশীলতা ঘাটতিগুলো কখনো চিহ্নিত হয়নি, উপরন্তু স্পর্শকাতর সময়গুলোয় নারীকে তার দুর্বল কর্মক্ষমতার জন্য তিরস্কৃত হতে হয়। সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে ভূমিষ্ঠ-পরবর্তী দীর্ঘ যাত্রায় গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত নারীদের জন্য বেতনসহকারে ছয় মাসের প্রচলিত মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধানটি মোটেই তার সামগ্রিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে যথেষ্ট নয়।
যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিরা ই ট্রোয়েগার নামে একজন গবেষক তার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারীদের মাতৃত্বকালীন উদার সুবিধা প্রদানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সব বিভাগে নারী শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত নারীরা তাদের মাতৃত্বকালীন সময়গুলোয় সাধারণত তাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল ও পদোন্নতি লাভের ক্ষেত্রে সামান্যই সফলকাম হন। গর্ভকাল থেকে শুরু করে সন্তানকে স্তন্যদানের দিনগুলোয় নারীরা বড় ধরনের উৎপাদনশীলতা ঘাটতির মুখোমুখি হন। উৎপাদশীলতা ঘাটতিটি পরবর্তী সময়ে তাদের পেশাজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, অর্থের বিনিময়ে যার ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। সুতরাং গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত নারীদের জন্য বাড়তি সুবিধা ও স্বীকৃতি প্রয়োজন।
আমাদের সমাজে সন্তান ধারণ তথা নারীর মাতৃত্বকে এখনো যার যার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়। অথচ একজন শিশু কিন্তু সমাজের সম্পদ। প্রকৃতিগত কারণে নারীরা সে সম্পদ উৎপাদনের জন্য দায়বদ্ধ। সমাজকে তাই চিহ্নিত করতে হবে, একজন নারীকে সন্তান জন্মদানের সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় কী ধরনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় বা কী ধরনের লোকসানের মুখোমুখি হয়। তাছাড়া সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে নারীরা তার জীবনের যাবতীয় ঝুঁকি গ্রহণ করেন, তাই মাতৃত্বকালীন সুবিধা কর্মজীবী নারীদের পেশাজীবনকে চলমান রাখতে বড় ধরনের স্বস্তি হিসেবে কাজ করে। যদিও এতে গবেষণাকাজে নিয়োজিত পেশাজীবী নারীরা বাড়তি যে ক্ষতির মুখোমুখি হন, তার প্রতিদানের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ক্ষতিপূরণ বাবদ কেবল অর্থ প্রদান নয়, বরং গর্ভকালীন তার সুনির্দিষ্ট উৎপাদশীলতা ঘাটতির বিষয়টি চিহ্নিত করে পরবর্তী সময়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় নেয়া জরুরি।
গর্ভকালীন নারীদের উৎপাদনশীলতা ঘাটতির বিষয়টি কী পদ্ধতিতে পরিমাপযোগ্য, তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। আমি কিন্তু এখানে একটি শিশুকে একটি গবেষণাপত্রের সঙ্গে তুলনা করতে বলছি না, বরং বিষয়টির গুণগত অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানাচ্ছি। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, কোনো ধরনের পদোন্নতি প্রদানে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীকে কর্মক্ষেত্রে তার উৎপাদনশীলতা ঘাটতির প্রশ্নে বিদ্ধ করার আগে দেখা জরুরি যে ওই নারী কর্মী সে সময় গর্ভাবস্থায় ছিলেন কিনা। আবার আমরা পদোন্নতির সময় নেতৃত্বগুণ, প্রশাসনিক গুণ, কাজে আগ্রহ—এসব গুণগত বিষয় যেমন আমলে নিই, তেমনি মাতৃত্বের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা দরকার।
একজন গবেষক কিংবা একজন বিজ্ঞানী হওয়ার পূর্বশর্ত খুব ভালো প্রাতিষ্ঠানিক ফল ও উচ্চতর ডিগ্রি। পেশাজীবী নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই অর্জনটি চ্যালেঞ্জিং। একজন বিবাহিত নারীকে তার লক্ষ্য অর্জনে যেসব কঠিন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে তুলনায় একজন বিবাহিত পুরুষের যাত্রাটা মসৃণ। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীকে তার ঘরে ও পেশাগত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ গুরুভার বহন করতে হয়। তাছাড়া উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণে বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিও তাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে ওঠে, যদিও শিক্ষা ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পেশাজীবীদের কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি প্রায় একান্ত জরুরি। এভাবেই একজন নারীর পেশাজীবনে মাতৃত্ব তার জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ যোগ করে, যদিও কেবল মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান ব্যতীত বিষয়টি কখনই যত্নসহকারে বিবেচনা করা হয়নি।
আসুন, বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা শুরু করি এবং কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বিবেচনা করি: ১. বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষণা (যেখানে ‘গবেষণা’ পেশাগত উন্নতির অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত) কাজে নিয়োজিত নারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সন্তান ধারণ ও মাতৃত্বের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তকরণ প্রয়োজন, পাশাপাশি এ ধরনের যেকোনো পেশার সঙ্গে সংযুক্ত নারীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচ্য; ২. বিষয়টি গুণগতভাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন নেতৃত্বের ক্ষমতা বিবেচনার মাধ্যমে অথবা গবেষণা প্রকল্প পরিচালনার সক্ষমতা যেমন পদোন্নতির মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়, তেমনি মাতৃত্বের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি; ৩. গর্ভকালীন কিংবা মা হওয়ার কয়েক মাসের ব্যবধানে নারীর সক্ষমতা ঘাটতির প্রতি কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করলে সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ; চার. বার্ষিক কর্মদক্ষতা প্রতিবেদনে গবেষণা পেশার সঙ্গে জড়িত নারীর ক্ষেত্রে মাতৃত্বের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা।
যেকোনো পেশার নারীদের জন্যই মা হওয়ার বিষয়টি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। তবে মাতৃত্বজনিত কারণে উৎপাদনশীলতা ঘাটতির বিষয়টি গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবী নারীদের অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। বিষয়টি তাই আনুষ্ঠানিভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা মাতৃত্ব শুধু কারো একার ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক দায়িত্বও।
লেখক: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
nazneen7ahmed@yahoo.com